আজকে শিক্ষক তোমাদের মজার গল্প, ভিডিও, গান, ছবি ও বই থেকে মাদার তেরেজা ও উইলিয়াম কেরি’র জীবনের ঘটনা প্রবাহ উপস্থাপন করবেন। শিক্ষক তোমাদের সাথে মাদার তেরেজা ও উইলিয়াম কেরির জীবন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। এক্ষেত্রে তিনি ছবি, ভিডিও, পোস্টার ও অন্যন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ব্যবহার করবেন।
চলো মাদার তেরেজা সম্পর্কে জানি।
জন্ম
মাদার তেরেজা ২৬শে আগস্ট ১৯১০ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের আলবেনিয়া রাজ্যের স্কপিয়তে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পরিবার ছিল আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত।
আহ্বান
১২ বছর বয়সে তিনি ঈশ্বরের কাজের জন্য আহ্বান পেয়েছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে তাকে খ্রীষ্টের কাজ করার জন্য একজন ধর্মপ্রচারক হতে হবে। ১৮ বছর বয়সে তিনি পিতা-মাতাকে ছেড়ে আয়ারল্যান্ডে ও পরে ১৯২৯ সালে ভারতে আইরিশ নান সম্প্রদায়ের “সিস্টার্স অব লরেটো” সংস্থায় যোগদান করেন। ডাবলিনে কয়েক মাস প্রশিক্ষণের পর তাকে ভারতে পাঠানো হয়। তিনি ভারতে ১৯৩১ সনের ২৪শে মে সন্ন্যাসিনী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণ করেন পরে ১৯৩৭ সালের ১৪ই মে চূড়ান্ত শপথ গ্রহণ করেন।
সেবা কাজ
তিনি কোলকাতার দরিদ্র পল্লিতে দরিদ্রতম দরিদ্রদের মধ্যে কাজ করেন। যদিও তার আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না। তিনি বস্তির জন্য একটি উন্মুক্ত স্কুল শুরু করেছিলেন। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর তেরেজা “ডায়োসিসান ধর্মপ্রচারকদের সংঘ” করার জন্য ভ্যাটিকানের অনুমতি লাভ করেন। এ সমাবেশই পরবর্তীকালে “দ্য মিশনারিজ অব চ্যারিটি” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। “দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটি” হলো একটি খ্রীষ্ট ধর্মপ্রচারণা সংঘ ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ১৯৫০ সালে তিনি “নির্মল শিশু ভবন” স্থাপন করেন। এই ভবন ছিল এতিম ও বসতিহীন শিশুদের জন্য এক স্বর্গ। ২০১২ সালে এই সংঘের সাথে যুক্ত ছিলেন ৪,৫০০জনেরও বেশি সন্ন্যাসিনী। প্রথমে ভারতে ও পরে সমগ্র বিশ্বে তার এই ধর্মপ্রচারণা কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রতিষ্ঠিত চ্যারিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে দরিদ্রদের মধ্যে কার্যকর সহায়তা প্রদান করে থাকে যেমন— বন্যা, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, নেশা, গৃহহীন, পারিবারিক পরামর্শদান, অনাথ আশ্রম, স্কুল, মোবাইল ক্লিনিক ও উদ্বাস্তুদের সহায়তা ইত্যাদি। তিনি ১৯৬০-এর দশকে ভারত জুড়ে এতিমখানা, ধর্মশালা এবং কুষ্ঠরোগীদের ঘর খুলেছিলেন। তিনি অবিবাহিত মেয়েদের জন্য তার নিজের ঘর খুলে দিয়েছিলেন। তিনি এইডস আক্রান্তদের যত্ন নেয়ার জন্য একটি বিশেষ বাড়িও তৈরি করেছিলেন। মাদার তেরেজার কাজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়েছে। তার মৃত্যুর সময় বিশ্বের ১২৩টি দেশে মৃত্যু পথযাত্রী এইডস, কুষ্ঠ ও যক্ষা রোগীদের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্র, ভোজনশালা, শিশু ও পরিবার পরামর্শ কেন্দ্র, অনাথ আশ্রম ও বিদ্যালয়সহ দ্য মিশনারিজ অফ চ্যারিটির ৬১০টি কেন্দ্র বিদ্যমান ছিল।
পুরস্কার
মাদার তেরেজা ১৯৬২ সালে ভারত সরকারের কাছ থেকে “ম্যাগসেসে শান্তি পুরস্কার” এবং ১৯৭২ সালে “জওহরলাল নেহেরু পুরস্কার” লাভ করেন। তিনি ১৯৭৮ সনে “বালজান পুরস্কার” লাভ করেন। মাদার তেরেজা ১৯৭৯ সনে দুঃখী মানবতার সেবাকাজের স্বীকৃতিস্বরূপ “নোবেল শান্তি পুরস্কার” অর্জন করেন। ১৯৮০ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান “ভারতরত্ন” লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে “প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম পুরস্কার” লাভ করেন। ২০১৬ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে একটি অনুষ্ঠানে পোপ ফ্রান্সিস তাকে “সন্ত” হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন এবং ক্যাথলিক মিশনে তিনি “কোলকাতার সন্ত তেরিজা” নামে আখ্যায়িত হন।
মৃত্যু
তিনি ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ ৮৭ বছর বয়সে কোলকাতার পশ্চিমবঙ্গে মৃত্যুবরণ করেন।
জন্ম
উইলিয়াম কেরি ১৭৬১ সালের ১৭ই জুন ইংল্যান্ডের পলাসপুরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আহ্বান
উইলিয়াম কেরি বাইবেলের যিশাইয় ৫৪ : ২-৩ পদের আলোকে ইংল্যান্ডে “অমর উপদেশ” দিয়েছিলেন। উপদেশটির প্রসিদ্ধ উদ্ধৃতিটি ছিল : “Expect great things from God; attempt great things for God.” [ঈশ্বরের কাছ থেকে মহৎ কিছু প্রত্যাশা কর; ঈশ্বরের জন্য মহৎ কিছু কর]। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের জীবন পরিবর্তন করার আহ্বান পেয়ে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। কেরি ১৭৯৩ সালের ১৩ই জুন একটি ব্রিটিশ জাহাজে লন্ডন থেকে যাত্রা করে নভেম্বর মাসে কোলকাতায় আসেন। তাকে “আধুনিক মিশনের জনক” বলা হয়।
কাজ
কেরি ১৭৯২ সালের অক্টোবর মাসে ইংল্যান্ডে ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটি গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে তা বিএমএস ওয়ার্ল্ড মিশন নামে রূপ নেয়। ১৭৯৪ সালে কেরি কোলকাতায় নিজের খরচে দরিদ্র শিশুদের জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। যা সমগ্র ভারতে প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তিনি সামাজিক প্রথা সংস্কার করে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয় চালু করেছিলেন। ১৮০৭ সালে কেরিকে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি সম্মান সূচক “ডক্টর অফ ডিভিনিটি” ডিগ্রি প্রদান করেন। ১৮১৭ সালে দেশীয় ছাত্রদের মাঝে পুস্তকের অভাব মেটানোর জন্য কোলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি স্থাপিত হয়। উইলিয়াম কেরির নেতৃত্বে ১৬জন ইউরোপীয়, ৪জন মৌলবি ও ৪জন বাঙালি হিন্দু নিয়ে এর পরিচালক সমিতি গঠন করা হয়। কেরি ১৮১৮ সালে “দিকদর্শন” নামে একটি মাসিক, “সমাচার দর্পণ” নামে একটি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা এবং “Friends of India” নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই বছর তিনি শ্রীরামপুর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা ছিল এশিয়ার প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী কলেজ। পরে কলেজটি শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয়। তিনি ১৮২০ সালে কোলকাতার আলিপুরে এগ্রি হর্টিকালচারাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। কেরি ও তার দল পাঠ্যপুস্তক ও অভিধান তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলা ও সংস্কৃতের ব্যাকরণ লিখেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ ও একজন ধর্ম প্রচারক।
তিনি সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। পরে ১৮২৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হয়। যেদিন আইন পাস হয় সেদিনই তিনি নিজে ঘোড়ায় চড়ে কোলকাতার লোকদের এই আইনের কথা জানিয়ে দেন। শিশুবলি ও সুত্তির প্রথা বন্ধ করতে সাহায্য করেছিলেন। জাতিগত বৈষম্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। উদ্ভিদবিদ্যার সাথে তার ছিল ব্যাপক পরিচিতি। তাকে “ভারতের প্রথম সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ” খেতাব দেওয়া হয়। তিনি হিন্দু ক্লাসিক ও রামায়ণ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কেরি বাংলা, ওড়িয়া, অসমীয়া, মারাঠি, হিন্দি এবং সংস্কৃত ভাষাসহ ৪৪টি ভাষায় এবং উপভাষায় সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বাইবেল অনুবাদ করেন। তিনি ভারতে প্রথম ছাপা মেশিন বা প্রেস চালু করেন।
মৃত্যু
১৮৩৪ সালের ৯ই জুন ৭৩ বছর বয়সে উইলিয়াম কেরি'র কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাকে শ্রীরামপুর ব্যাপ্টিস্ট মিশনারীদের সমাধি ক্ষেত্রে সমাহিত করা হয়।
খ্রীষ্টধর্মের অন্যতম একটি নীতিগত বিষয় হলো সমাজের সকল মানুষের সাথে সম্প্রীতিতে বসবাস করা। সৃষ্টিকে ভালোবেসে ও সম্প্রীতিতে অবস্থানের জন্য খ্রীষ্ট ধর্ম বিশ্বাসীরা সমাজে বিভিন্ন সেবাধর্মী কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে মানুষের কাঙ্খিত বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ।
শিক্ষা
খ্রীষ্টধর্ম অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশে উচ্চতর গুণগত মানসম্পন্ন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে সব ধর্মের মানুষ শিক্ষার সুযোগ পেয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন, মূল্যবোধ, নৈতিকতা চর্চা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। পবিত্র বাইবেলে লেখা আছে,“সবশেষে বলি, তোমরা সবাই পরস্পরের সঙ্গে মিল রেখে বসবাস করো; তোমরা সহানুভূতিশীল, একে অপরকে ভালোবাসো, দরদি ও নতনম্র হও” (১ পিতর ৩ : ৮)। খ্রীষ্ট বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করে যে, সব ধর্মের সকল শিশুর জীবন গঠনের জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা তাদের দায়িত্ব।
অন্যদিকে দেশের শিক্ষার চাহিদাপূরণে এ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের সাথে একযোগে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সকলের শিক্ষা গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত।
স্বাস্থ্য
খ্রীষ্টধর্ম অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে বেশ কিছু স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যসেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্য সচেতনতা উন্নয়ন, প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয় যা জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এর সুবিধা পেয়ে থাকে। শারীরিক, মানসিক ও আবেগিক অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাধ্যমে সমাজে সম্প্রীতি চর্চা করে থাকে।
সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত সমস্যা নিরসনকল্পে খ্রীষ্টধর্মের অনুসারীদের দ্বারা পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজ ও মানুষের প্রয়োজন মেটাতে ও তাদের পাশে দাঁড়াতে সর্বদা তৎপর যেমন— বন্যার্তদের সাহায্য করা, খরা, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যায়গুলোতে সরকারের পাশাপাশি সর্বদা সমমনায় কাজ করা। স্বাধীনতা সংগ্রামে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, শান্তিস্থাপনে চার্চ ও চার্চের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় সম্প্রীতি চর্চা করে চলছে। বাইবেলে লেখা আছে, “একে অন্যকে ভাইয়ের মত গভীরভাবে ভালবাসো। নিজের চেয়ে অন্যকে বেশী সম্মান করো” (রোমীয় ১২ : ১০)।
Read more